জাতিসংঘের শান্তি মিশনের সৈনিক পাঠাতে সমস্যা কোথায়?
এম.আর মাহমুদ ::
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবিক বিপর্যয়, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ দেখে মনে হয় বিশ্ব মানবতা প্রতিনিয়ত পদদলিত। বর্মী হানাদার ও স্থানীয় বোদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছার ফলে সেখানকার বাসিন্দারা সহায়-সম্পদ ফেলে জন্মস্থানের মায়া ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের করুণ অবস্থা দেখে মনে হয় যেন বর্মী হানাদার ও বেসামরিক নাগরিকদের নির্যাতন হিটলার বাহিনীর নির্যাতনকে হার মানিয়েছে। গত কয়েকদিনের জাতীয় দৈনিক সমকালে ছাপানো ছবিগুলো দেখলে অনুমান করা যায় কিভাবে অসহায় মানুষগুলোর বসতবাড়ি ছেড়ে টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করছে। এসব পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চেহারা দেখলে মনে পড়ে যায় পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের ‘আসমানি’ কবিতার কথা। মিয়ানমারের হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যে এ পারে আশ্রয় নিয়েছে। সীমান্তরক্ষীরা পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় না হলে তাদের পরিণতি কি হতো একমাত্র আল্লাহই জানে। এদিকে টেকনাফ, উখিয়ার কিছু চিহ্নিত অপরাধী পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়-সম্পদ ও ইজ্জত আব্র“ লুটে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মিয়ানমারের অত্যাচারী শাসকের কবল থেকে প্রাণে বাঁচতে এখানে এসেও তারা কতিপয় অপরাধীর তান্ডব থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। বনের হরিণ যখন বিপদগ্রস্থ হয়, তখন বাঁচার তাগিদে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এ সময় কিছু মানুষ বিপণœ হরিণকে জবাই করে মাংস খায়। অবস্থাটি অনেকটা অনুরূপ। এ ধরণের অপরাধ দমনে উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশের ভূমিকা অতীব জরুরী। সরকার মানবিক কারণে আরাকানের মুসলমানদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। অথচ কতিপয় অপরাধীর কারণে এ প্রশংসা প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেয়া যায় না। সরকার ইচ্ছা করলে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের এদেশে প্রবেশ ঠেকাতে পারত। তখন এই বিপণœ মানুষগুলো মরণ ছাড়া কোন গতিই ছিল না। শুধুমাত্র মানবিক কারণে সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দিচ্ছে। তারা কবে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সেই নিশ্চয়তা কেও দিতে পারবেনা। এদিকে ভারতের বিজিপি সরকার প্রধান মোদি বাবু মিয়ানমারে গিয়ে অংসান সূচির সাথে হাত মিলিয়ে ঘোষণা দিয়েছে ভারতে থাকা রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে তাড়িয়ে দেবে। ভারত কর্তৃক বিতাড়িত হলে ওইসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে বাংলাদেশে। এছাড়া তাদের কোন বিকল্প স্থান আছে বলে মনে হয় না। রোহিঙ্গারা যেন জ্বলন্ত কড়াইয়ের কৈ মাছ। তারা বাঁচার তাগিদে লাফিয়ে পড়লেও পড়ছে জ্বলন্ত চুলায়। এদিকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের এভাবে অত্যাচার চালানোর পরও বিশ্বের ৫৫টি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে বেশিরভাগ রাষ্ট্র রাষ্ট্রের ভূমিকা অনেকটা দেখার মত না হলেও এখন কিন্তু অনেকটা সোচ্ছার হতে দেখা যাচ্ছে। অথচ হাতে-গোনা স্বল্প সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে বর্মী হানাদার বাহিনী কর্তৃক তাড়িয়ে দেয়ার সংবাদ পেয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের অন্যতম নেতা এডভোকেট রানা দাশ গুপ্তের নেতৃত্বে একদল নেতাকর্মী এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার যেতে কৃপণতা করেনি। রোহিঙ্গা মুসলমানদের এমন বিপর্যয়ের পরও বেশিরভাগ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধানেরা তাদের অবস্থা দেখতে কর্ণধারদের ঘুম ভাঙ্গেনি। একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্কই প্রথম রোহিঙ্গা মুসলমান নিধন বন্ধের দাবী জানিয়ে গর্জে উঠেছে। ইতিমধ্যে সে দেশের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী টেকনাফে গিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের করুণ অবস্থা পরিদর্শন করেছে। এছাড়া এক হাজার টন ত্রাণ সামগ্রীও ইতিমধ্যে পৌঁছে দিয়েছে; এক কথায় বলতে হয়: তুরষ্কের মত সব কটি মুসলিম রাষ্ট্র এগিয়ে আসলে রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের এমন দূর্ভোগ হওয়ার কথা নয়। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়াচ্ছে। বিলম্বে হলেও মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিয়ে গঠিত ও.আই.সি মুখ খুলেছে। বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম সম্পদ ভান্ডার সৌদি আরবের নড়াচড়াও পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইতিপূর্বে সৌদিআরব, মালয়েশিয়াসহ অনেক মুসলিম রাষ্ট্র বেশুমার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। যা অস্বিকার করা যথাযথ হবেনা। মিয়ানমারের সরকার আরাকান মুসলমানদের সেদেশের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। মিয়ানমারের জান্তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করছে না। উল্টো বলে বেড়াচ্ছে তারা নাকি বাঙ্গালী। আর হিন্দুরা ইন্ডিয়ান। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার (বার্মা) স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সে সময় থেকেই ওই এলাকার মুসলমানেরা সেদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় (মগদের হাতে) বারবার নির্যাতিত হয়েছে। মিয়ানমারের কর্ণদ্বার শান্তিতে নোবেল বিজয়ী (হয়তো মুসলিম নিধনের জন্য) সূচির পিতা জেনারেল অংসান সে দেশের শাসক হিসেবে দীর্ঘদিন রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের কপালে এতবেশি বিপর্যয় ঘটেনি। সে কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা অংসান সূচিকে তাদের প্রিয় নেত্রী হিসেবে জানত। কিন্তু আজ তিনি মিয়ানমারের কর্ণধার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘভূক্ত অনেক দেশেই এ ধরণের সমস্যা আছে। যা দমন করতে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সৈনিকদের মাধ্যমে এসব জাতিগত দাঙ্গা থামাতে বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছে। অথচ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের নৃসংশভাবে হত্যা, ধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম জালিয়ে দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে। অথচ রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশ ছাড়া করে যাচ্ছে। এ ধরণের হত্যাযজ্ঞ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ থামাতে শান্তি মিশনের সৈনিকদের পাঠাতে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না জাতিসংঘ। কারণ মিয়ানমারের পক্ষে চীনের ভূমিকা রয়েছে। এই শক্তিধর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো ভূমিকা নিতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ চীনের ভেটো ক্ষমতা আছে। ফলে জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেনা। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে শুধু একটি কথাই বলতে হয় রোহিঙ্গারা কোন ধর্মাবলম্বী তা বড় কথা তারাও মানুষ। তাদের পরিচয় শুধু মুসলমান নয়; কবির ভাষায় বলতে হয় ‘হরেক বর্ণের গাভী রে ভাই একই বর্ণের দুধ, হরেক বর্ণের মানুষ রে ভাই একই মায়ের পুত’।
এম.আর মাহমুদ
চকরিয়া
পাঠকের মতামত: